টেকনাফের কারবারিদের ঘুম নেই আলিশান ঘরে * নাজির পাড়ায় এখন মৃতের দাফন কার্য করার মতো পুরুুষও নেই। * অর্ধশত শীর্ষ কারবারি এলাকাছাড়া * আত্মসমর্পন করেছে ৭ জন * বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৪ জন য় সম্পদ জব্দ হয়েছে মাত্র একজনের

ইয়াবা গ্রাম নাজির পাড়ার কারবারিরা ঘরছাড়া

কালেরকন্ঠ :

টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিতি রয়েছে নাজির পাড়া গ্রামের। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের এই গ্রামটি নাফ নদের তীরবর্তী হওয়ায় একসময় দেদারছে চলেছে ইয়াবা কারবার। ইয়াবার ছোবল থেকে বাদ পড়েনি এই গ্রামের কোন মানুষ। কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ সবাই মিলে একসাথে যে যার মতো চালিয়ে গেছে ইয়াবা কারবার।

লজ্জাশীলতা বাদ দিয়ে পিতা-পুত্র মিলে ইয়াবা কারবার করতেও দ্বিধা নেই এই গ্রামের মানুষের। ঝাঁকের কৈ’র মতো পিতা, মাতা, পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও নারীরাও একে অপরকে সহায়তা করত ইয়াবা কারবারে। তাই এই গ্রামের মানুষের কোটিপতি হতে বেশি সময়ের অপেক্ষা করতে হয়নি।

একসময় দিনদুপুরেও এই গ্রামে যেতে মানুষ ভয় পেত। সেসময় ইয়াবা কারবারিদের আধিপত্য ও দাম্ভিকতায় ভয়ের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল নাজির পাড়া। সেখানে গেলে ইয়াবা কারবারিরা যে কাউকে প্রশাসনের লোক বা সাংবাদিক ভেবে অগত্যা লাঞ্চিত করতো এবং মারধর করতো। হামলার আশঙ্কা থেকে ভয়ে কোন সাধারণ মানুষ তখন ওই গ্রামে যেতে চাইতনা। নাফনদ তীরের সেই ইয়াবা গ্রামটিই এখন বলতে গেলে পুরুষশূণ্য। এমনকি নাজির পাড়ায় এখন মৃতের দাফন কার্য করার মতো যুবক বা পুরুষও নেই।
শুধু তাই নয় ২০১৬ সালে কক্সবাজার থেকে একদল সাংবাদিক ঐ গ্রামে ইয়াবা সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে ইয়াবা কারবারিদের স্বশস্ত্র হামলার শিকার হয়েছিল ঐ সাংবাদিকরা। হামলায় গুরুতর আহত হয় ৬ সাংবাদিক। নাজির পাড়ার ইয়াবা গড ফাদার নুরুল হক ভুট্টোর নেতৃত্বে এই হামলা হয়েছিল।

এসব প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানান-‘আমরা সীমান্তের প্রতিটি ইয়াবা বাড়ী এবং প্রতিটি ইয়াবা পাড়ায় হানা দেব। ইয়াবা কারবারিরা যতদিন পর্যন্ত কারবার ছেড়ে দেবে না ততদনি ধরেই চলবে অভিযান। এক কথায় তাদের নাস্তানুবাদ করেই ছাড়ব।’ পুলিশ সুপার বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, দেশকে মাদকমুক্ত করতে আইনের প্রয়োগে যেরকম কঠোরতার দরকার সেটুকুই করা হবে।
একসময় দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা নাজির পাড়া গ্রামের প্রায় মানুষ ইয়াবার স্পর্শে এসে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। ইয়াবার বদৌলতে অবৈধপথে উপার্জন করেছেন কাড়ি কাড়ি টাকা।

ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে এই গ্রামের এক সময়ের পিঠা বিক্রেতা, রিক্সা চালক, ভ্যান চালক, ফেরিওয়ালা তারাও কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। নুন আনতে পান্তা পুরায় অবস্থা যাদের, ইয়াবার উপার্জনে তাদের অনেকেই করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। কেউ কেউ সম্পদ দৃশ্যমান হওয়ার আশঙ্কায় আলিশান বাড়ি করার পরিবর্তে কিনে রেখেছেন কোটি কোটি টাকার জায়গা জমি। ওই সময়ে দিনের নাজির পাড়ার চেয়ে রাতের নাজির পাড়া ছিল আলোয় ঝলমল। আলিশান অট্টালিকা ও ইয়াবা কারবারিদের ভিটেবাড়ি রাতের ঝলমলে আলোতে ঝিকঝিক করতো।

ইয়াবা কারবারের টাকায় নাজির পাড়ার মানুষ তাদের নিজেদের জীবনের সুখ সাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় করেছে কোটি কোটি টাকা। শক্তি সামর্থ্যরে প্রমাণ দিতে অনেক ইয়াবা কারবারিরা স্বশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীও লালন করেছে ওই গ্রামে। ইয়াবা ঘাটের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে সেখানে।
দীর্ঘ সময় ইয়াবার প্রবেশদ্বার বা ইয়াবা গ্রাম হিসেবে পরিচিত নাজির পাড়ার দৃশ্য এখন অনেকটাই পাল্টেছে। ইয়াবা কারবারের ভরমৌসুমে এসে এ গ্রামের ইয়াবা কারবারিদের ভিত ভাঙতে ‘চিনে জোঁকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন টেকনাফ থানা পুলিশের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। পুলিশের উপর্যূপুরি অভিযানে শেষ পর্যন্ত ভিত নড়েবড়ে হয়ে যায় নাজির পাড়ার ইয়াবা কারবারিদের। সেদিনের আলো ঝলমলে গ্রামটি এখন প্রায় পুরুষশুণ্য হয়ে ভূতের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার তৈরী করা ইয়াবা কারবারির তালিকায় নাজির পাড়ায় অন্তত ২০ জনের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে ৪ জন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন এবং ৭ জন আত্মসমর্পন করেছেন। এছাড়া সরেজমিন অনুসন্ধানে ওই গ্রামে আরো অর্ধশতাধিক শীর্ষ ইয়াবা কারবারির নাম জানা গেছে। তারা এখন পুলিশের ভয়ে ছন্নছাড়া হয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।

ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে অর্থ ও শক্তির আধিপত্য বিস্তারকারী নাজিরপাড়া গ্রামের প্রতাপশালীরা এখন ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। তাদের কেউ এখন নিজেদের আলিশান ঘরে ঘুমাতে পারছেনা। আত্মীয়স্বজনদের মরা মুখ দেখতেও তারা এলাকায় আসতে পারছেননা। নিজেদের অপকর্মের বেড়াজালে তারা নিজেরাই আটকা পড়েছেন। সরকার ঘোষিত মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কারণে এ গ্রামের কোটিপতি ইয়াবা কারবারিদের স্বপ্নযাত্রা যেন এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। তবে তাদের মধ্যে ইয়াবা কারবারি মৌলভী নুরুল হক ভুট্টো একজন ছাড়া বাকিদের সম্পদ জব্দ না হওয়ায় তারা পরিস্থিতি বুঝে আবারও এলাকায় এসে ইয়াবা কারবারে বিনিয়োগ করার শংকা রয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরে সরেজমিনে গ্রাম ঘুরে জানা যায়, দুই শতাধিক পরিবারের বসতির নাজির পাড়া গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই রয়েছে ইয়াবা কারবারি। কোন কোন পরিবারে বাড়ির সব পুরুষ সদস্যই ইয়াবা কারবারের বড় গডফাদার। ইয়াবা সা¤্রাজ্যখ্যাত নাজির পাড়ার সবচেয়ে বড় ইয়াবা গডফাদারের নাম ছিদ্দিক আহমদ। পিতার সাথে ইয়াবা কারবার সামাল দিয়ে ছেলে ফরিদ আহমদও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

নাজির পাড়া গ্রামের অন্য গডফাদারদের মধ্যে এজাহার মিয়ার ছেলে নুরুল হক ভুট্টো, তার ভাই নুর মোহাম্মদ মংগ্রী ও খোকনও রয়েছেন। ভূট্টোর রয়েছে আলিশান দুটি বাড়ি এবং কোটি টাকার জায়গা জমি। সর্বশেষ গত ১ জুন আদালতের নির্দেশে পুলিশ তার বাড়িসহ প্রায় ৩৫ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে। এর আগে তার ভাই নুর মোহাম্মদ মংগ্রীও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ভূট্টোর বিরুদ্ধে দায়িত্বপালন কালে সাংবাদিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে মামলাও হয়েছিল। বর্তমানে এ ইয়াবা কারবারি ও সন্ত্রাসী এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানা যায়।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারী টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পন করেছেন নাজির পাড়ার শীর্ষ ৭ জন ইয়াবা কারবারি। তারা হলেন, এনামুল হক @ এনাম মেম্বার, সৈয়দ হোসেন, জামাল হোসেন, আব্দুর রহমান, জাফর আলম, মোঃ রফিক, মোঃ হেলাল। এছাড়া পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জিয়াউর রহমান, কামাল হোসেন, দুদু মিয়া ও নুর মোহাম্মদ মংগ্রী নামে ৪ জন ইয়াবা কারবারি নিহত হয়েছে। এই ১১ জন ইয়াবা কারবারি ছাড়াও অনুসন্ধানে পাওয়া প্রায় ৭০ জনের অধিক বড়মাপের ইয়াবা কারবারির বাকিরা দেশেই আত্মগোপন করেছেন।
আত্মসমর্পনের বাইরে থাকা নাজির পাড়ার যেসব বড় ইয়াবা কারবারি রয়েছেন তারা হলেন, ছিদ্দিক আহমদ, ফরিদ আহমদ, নুরুল হক ভুট্টো, খোকন, মোঃ আলী, মোঃ আয়ুব, সৈয়দ আলম, নুর আজিজ মিয়া, মোঃ ইসমাইল, জসিম উদ্দীন, নুরু, আকতার, আমির হোছন, জাফর আলম, মোঃ রাশেদ, মোঃ রফিক, কালু মিয়া, শাহাব মিয়া শাফু, নুরুল ইসলাম, নুরুল আলম, ফরিদ আলম, আব্দু শুক্কুর , মোস্তাক আহমদ, কামাল হোসেন, আবুল কালাম, ধইল্যা , মোঃ আয়ুব, জাফর আহমদ, সৈয়দ আলম, জাফর আলম, ভুলু, জামাল হোসেন, নুরুল আলম, মোঃ আলমগীর, নবী উল্লাহ, মিয়া, জসিম উদ্দীন, সোনা মিয়া, মোঃ আলম, খোরশেদ আলম, রেজাউল করিম, আব্দুল গফুর, ফিরোজ আহমদ, মোঃ তকির, সালেহ আহমদ, নুরুল আলম, গুরা মিয়া, আব্দু শুক্কুর প্রমূখ।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশের একের পর এক কার্যকর অভিযানে প্রথম দিকেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিটকে পড়ে বড় ইয়াবা কারবারিরা। এরপর ইয়াবা গ্রাম নাজির পাড়াকে টার্গেট করে পুলিশও থেমে থাকেনি। উপুর্যূরি পুলিশের মাদক বিরোধী ওই অভিযানে শেষ পর্যন্ত ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে নাজির পাড়ার ইয়াবা গডফাদাররা। ধরা না পড়লেও এ গ্রামের ইয়াবা কারবারিরা কেউ এখন এলাকায় নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, যে গ্রামে দিন দুপুরে কোন সাধারণ মানুষ কোন প্রয়োজনে গেলেও ইয়াবা কারবারিরা প্রশাসন বা সাংবাদিক ভেবে তাকে লাঞ্চিত ও মারধর করতেন, সে নাজির পাড়ায় এখন মৃতের দাফন কার্য সারাবার মতো যুবক বা পুরুষ নেই। ছেলের ইয়াবা কারবারের অপরাধে গ্রেফতারের ভয়ে অনেক বৃদ্ধ পিতারাও এলাকায় থাকছেন না। ইয়াবা কারবারি কোটিপতি ভুট্টোর যে মায়ের গত কয়েক বছরের জীবন কেটেছে ছেলের গড়া রাজপ্রাসাদসম ডুপ্লেক্স বাড়িতে, সেই ভূট্টোর মা এবারের ঈদ করেছে কুড়ে ঘরে। ঈদের আগেই কারবারি ভূট্টোর বাড়িটি জব্দ করার ফলে পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

টেকনাফ সীমান্তের নাফনদ তীরের নাজির পাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একসময় হালাল ব্যবসায়ের মতো যে যার মতো করে প্রতিযোগীতা দিয়ে ইয়াবা কারবার করেছে। তখন ঘরে ঘরে ইয়াবা কারবারি সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদের দেখাদেখিতে অর্থের লোভে পড়ে আমার ছেলেটাকে নিষেধ করেও ইয়াবা কারবার থেকে বিরত রাখতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তাদের পাপের পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। এ মুহুর্তে তাদের মা-বাপ মারা গেলেও জানাজা, কাফন- দাফন দেয়ার সুযোগও তাদের নেই।’